আয়নামহল (পর্ব-২)
-সঞ্জয় গায়েন
৫
টয়লেটে ছিঁড়লো প্যান্ট জামা
আমার কান্নায় ওদের থামা
তখন ক্লাস নাইনে উঠে গিয়েছি। বড় না হলেও আর ছোট বলা যায় না। নিজেকে একটু একটু হলেও বুঝতে শিখছি। নিজের পছন্দ অপছন্দ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই আর ছেলেদের মতো জামা প্যান্ট পরে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত না। বিশেষ করে বুক দু’টোর জন্য। জামা পরলে কেমন উঁচু হয়ে থাকতো। মা’কে একদিন বলেছিলাম, মা আমি মেয়েদের মতো ফ্রক পরে স্কুলে যাব। শুনেই মা এত রেগে গিয়েছিল কি বলব। আচ্ছা মাও তো মেয়ে। মা-র কি চোখ পড়তো না আমার উপর? না কি দেখেও না দেখার ভান করে থাকতো? কি জানি? কিছু চাইলেই তো বলে উঠতো, বড় হয়ে গিয়েছ, এবার সব নিজে নিজে করে নিতে শেখ। মা-র কথামতো নিজে নিজেই একদিন স্যান্ডো গেঞ্জির পরিবর্তে স্ক্রিন ফিটিং ইনার কিনতে গিয়েছিলাম। দোকানদার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে গেঞ্জি ও জামা পরেই স্কুলে যেতাম। তার উপর আমাদের স্কুলটা ছিল শুধু ছেলেদের স্কুল। তাই ছেলেদের পাশেই বসতে হত। এক বেঞ্চে পাঁচ পাঁচজন। গায়ে গা ঠেকে যেত। কী যে অস্বস্তি হত। সেই অস্বস্তি এড়াতে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইতাম। কিন্তু চাইলেই কি গুটিয়ে নেওয়া যায়। যায় না। আমি যত বেশি করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে যেতাম আমাদের ক্লাসের সহপাঠীরা আমাকে তত বেশি করে টেনে নামাতো। আমি যেন ওদের কাছে একটা রাবারের বলের মতো ছিলাম। যার যখন যা ইচ্ছে হত, আমাকে নিয়ে তাই করত। কেউ এসে চুল টেনে ধরত। কেউ গাল টিপে টেনে ধরত। আর আমায় দেখে হাসাহাসি করা, ধাক্কা দেওয়া, কাঁধে খেমচে ধরা এসব তো ডেলি রুটিন হয়ে গিয়েছিল। ওসব আমার ধীরে ধীরে অভ্যেসও হয়ে যাচ্ছিল। বরং যেদিন কেউ কিছু করত না, সেদিন মনে হত, কি ব্যাপার আজ কি ক্লাসের সবার মন খারাপ। কেউ আমার পিছনে লাগছে না যে।
আমি প্রত্যেকটা দিন মনমরা হয়ে পিছনের বেঞ্চে বসে ব্যাগে মুখ গুঁজে নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু ক্লাসশুদ্ধু সকলের প্রথম কাজ ছিল আমাকে খুঁজে বের করা আর টানাটানি করা।
এভাবেই কাটছিল আমার স্কুলবেলা। কিন্তু সেদিন যা হয়েছিল তা মনে পড়লে এখনো আমি শিউড়ে উঠি। আমাদের স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস ছিল। সামনের মাঠে সবাই খেলায় ব্যস্ত। আমি দোতলায় উপরের বারান্দা থেকে খেলা দেখছিলাম। দেখতে দেখতে টয়লে্ট পেয়েছিল। তাই নীচে নামতে হয়েছিল। নেমে এসে যেই টয়লেটে ঢুকেছি, দেখি আমাদের ক্লাসের চার পাঁচজনও পিছু পিছু টয়লেটে এসেছে। একে স্কুলের টয়লেট, তার উপর শুধু ছাত্রদের জন্য। দরজা থাকলেও তা বন্ধ করে লক দিয়ে একজন একজন টয়লেট করবে তেমন ব্যবস্থার প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে একসঙ্গে অনেকজন করে ঢুকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে টয়লেট করে। আর করতে করতে একে ওপরের পেনিস দেখে। কারটা ছোট কারটা বড় কারটা মোটা কারটা কালো এসব নিয়ে গল্পও করে। আমি কোনদিনও এসব গল্পে ঢুকতামই না। বরং আমি টয়লেটে গেলেই পায়খানা করার ঘরে ঢুকে ছিটকিনি দিয়ে বসে টয়লেট করতাম। ওদিনও তেমনই করতে যাচ্ছিলাম, কে যেন বলে উঠেছিল, অ্যাই তুই কি খেয়ে আসিস রে রোজ তোর পায়খানা পাায়। আমি সরল মনে বলে ফেলেছিলাম, না পায়খানা করব কেন? টয়লেট করার জন্যই… বলে ফেলেই বুঝতে পেরেছিলাম কী ভুল বলে ফেলেছি। কিন্তু কথা তো তীরের মতো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এইটুকু শুনেই ওরা সব বুঝে গিয়েছিল। ব্যাস, আর আমি যাই কোথা। ওরা কিছুতেই ছিটকিনি লাগিয়ে আমাকে টয়লেট করতে দেবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। কিন্তু ওদের একটাই বুলি ছেলে হয়ে ছেলেদের সামনে দাঁড়িয়ে টয়লেট না করলে ওরা স্যারকে বলে দেবে।
এমন কথা শুনে আমার খুব ভয় করতে লাগলো। আর একবার ভয় পেলে মাথা কাজ করে না। কি করা উচিৎ, কোনটা উচিৎ নয় সব যেন গুলিয়ে যায়। সেদিনও তাই হয়েছিল। আমি জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছিলাম। ওরা তখনও পায়খানার দরজা আটকে দাঁড়িয়ে। একবার মনে হচ্ছিল, ওদের হাতে পায়ে ধরে বলি যে আমায় তোমরা ছেড়ে দাও। কিন্তু ততক্ষণে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। কথা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ছাড়া কোন আওয়াজ বের হচ্ছিল না।
ওদিকে ওরাও গোঁ ধরে বসেছিল, ওদের সামনে প্যান্টের চেন খুলে দাঁড়িয়ে টয়লেট করতে হবে। নইলে ওরা আমাকে ‘ছেলে’ বলে মানবে না। বলতে বলতে আমার জামা ধরে টানাটানিও করছিল। আর সেই টানাটানিতে জামার দু’টো বোতাম ছিঁড়ে যায়। ছেঁড়ামাত্রই হাট হয়ে দেখা যাচ্ছিল আমার বুক দুটো। আমি তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। দুই হাত দিয়ে কোনরকমে বুকটা আড়াল করতে চেষ্টা করছিলাম আর কাঁদছিলাম। আমার চোখের জল আর ঘামে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছিল। ওরা তখনও থামে নি। হ্যাঁচকা টানে দু’জন আমার দুইহাত টেনে ধরেছিল। আর দু’জন প্যান্টের চেন খুলে… আমি হাত পা ছুঁড়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। হাঁসফাঁস করছিলাম। দমও বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ যেন আমার গলার আওয়াজ ফিরে পেয়েছিলাম। আমি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ করে চিৎকার করে উঠেছিলাম। সেই চিৎকারে ওরা থমকে ওঠে। তারপর পায়খানা ঘরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল।
৬
স্যারকে নালিশ করে
মহা বিপদ এল ঘরে
ভাইকে পছন্দ করতাম না ঠিকই। ওর উপর রাগও হত। আসলে ওকে দেখে সবাই যেমন হা হা হি হি করত, তেমন সুযোগ পেলেই আমাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে করে আমার মাথা খেয়ে ফেলতো। সবার কাছে জবাবদিহি করতে করতে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। বিশেষ করে স্কুলে। রাগে-বিরক্তিতে কতবার বাবার কাছে বলেছি, ভাইকে অন্য স্কুলে ভর্ত্তি করে দাও। করে নি। তবে তার বিনিময়ে একটা ব্যাপারে বাবাকে রাজী করিয়েছিলাম। ভাই যেন আমার সঙ্গে স্কুলে না যায়। স্কুলে আমার সঙ্গে কথা না বলে। তাই শুনে মা একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল। বলেছিল, তোরই তো ভাই। তার উপর সবই তো জানিস। সবাই কিরকম ওর পিছনে লাগে। তুই দাদা হয়ে ওকে একটু চোখে চোখে রাখলে ওর সুবিধা হত। ও না হয় একা একাই যাবে। তুই শুধু স্কুলে একটু খেয়াল রাখিস। আমি মায়ের মুখের উপর ‘না’ বলে দিয়েছিলাম। বলাটা হয়তো উচিৎ হয় নি। তবু বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ ওর জন্য আমাকেও সবার কাছে কথা শুনতে হত। সেটা তো মা বুঝতো না। জানতোও না। অবশ্য আমিও জানাতে চাই নি। ভাইকে নিয়ে মাকেও তো কম কথা শুনতে হত না। পাড়ায়-আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যেখানেই মা যেত সব্বাই কথা শোনাতো। কেউ হেসে হেসে, কেউ ঠোঁট বেঁকিয়ে। কেউবা দরদ দেখানোর ভান করে। মাও সব বুঝতো। কিচ্ছু বলতে পারতো না। ভাই যে এমন হাফলেডিসের মতো দিন দিন মেয়েলি হয়ে যাচ্ছিল তা নাকি মায়ের জন্যই। আসলে আমাদের সমাজটাই এমনি। ছেলে মেয়ের যাই হোক প্রথমেই তার জন্য বাপ মা’কে দায়ী করা হয়। বিশেষ করে মা’কে।
সে যাক গে। কি আর করা যাবে। আমরা তো আর সমাজ পাল্টাতে পারবো না। ভাইকে পাল্টাবার চেষ্টা করতাম। তাই ভাই জেদ করলেও ওকে ফ্রক পড়তে দেওয়া হত না। একবার মেয়ে সাজালে আর কি রক্ষে থাকতো? এমনিতেই ছোটবেলায় মেলার গাজনে ওকে মেয়ে সাজিয়েছিল বলে সেই নিয়ে কম কথা হয়েছিল নাকি। সেটা তবু মেলা ছিল, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে মেয়ে না হয়ে মেয়েদের পোশাক পরতে চাওয়া পাগল ছাড়া আর কেউ ভাবে না। ওর সেই পাগলামো ছিল। বাবা সেজন্য ডাক্তারও দেখিয়েছিল। কিছুদিন ওষুধ খেয়ে ভালোও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওষুধ বন্ধ হওয়ার পর আবার যেই কে সেই। তাই বলে ওর ফ্রক পরতে চাওয়ার আবদার মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে নি। পড়তে দেওয়াই হয় নি কোনদিন। হ্যাঁ, ওর হরমোনাল কিছু সমস্যা হয়তো ছিল। সেজন্য বুক দু’টো একটু বড় বড় দেখাতো। তবে ওগুলো মেয়েদের মতো স্তন মোটেও ছিল না। কিন্তু ভাই তা বুঝতো না। বাড়িতে একটা দিনও খালি গায়ে থাকতো না। এমনকি বাথরুমে স্নান করতে ঢুকলেও গামছা গায়ে দিয়ে ঢুকতো আর বের হত। হাজার বলেও ওকে পাল্টানো যায় নি। শেষে আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু সেদিন স্কুলে কি যে হল আমার, জানি না। বন্ধুদের সঙ্গে বসে মাঠে স্পোর্টস দেখছিলাম। হঠাৎ বাথরুম থেকে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে দেখি, ভাই মুখ ঢেকে কাঁদছে। কি হয়েছে রে, জিজ্ঞেস করতে ভাই কেঁদে কেঁদেই বলেছিল, আমাদের ক্লাসের চারজন বাথরুমে ঢুকে আমার জামা প্যান্ট ছিঁড়ে…। শুনে আমারও মাথা গরম গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে নিয়ে গিয়ে স্যারের কাছে নালিশ করেছিলাম।
কিন্তু স্যার সবটা শুনলেন না। মাঝপথে হাত তুলে আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সব বুঝেছি। যাও ভাইকে নিয়ে বাড়ি যাও। আর কাল তোমার বাবাকে স্কুলে আসতে বলবে একবার। বলবে, স্যার ডেকেছেন। খুব দরকারী কথা আছে। অবশ্যই যেন আসেন।
বাবা পরদিনই অফিস কামাই করে স্কুলে গিয়েছিল। স্যার কি বলেছিলেন জানি না। তবে বাবা ফিরে এসে ভাইকে বেধড়ক মেরেছিল। আর বলেছিল, এরপর যদি স্কুল থেকে তোমার নামে কোন নালিশ আসে তাহলে তোমার স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেব আমি।
৭
পাড়ার ডাক্তার টিপল বুক
অস্বস্তি হলেও হল সুখ
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার বুক জুড়ে কুসুমের মতো ফুটে থাকা বুক দু’টো বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমে স্নান করতে ঢুকে রোজ দেখতাম, হাত বুলোতাম। লজ্জা লজ্জা লাগতো। তবু না দেখে থাকতে পারতাম না। দেখতাম আর ভাবতাম এ তো পুরো মায়ের মতো হয়ে উঠছে। পরক্ষণেই মনে পড়ে যেতো, আমি তো ছেলে। কি করব এবার? ছেলেদের তো অমন বুক থাকে না। থাকতেও নেই। তাই বাধ্য হয়ে একদিন দুপুরে মায়ের ঘরে গেলাম। মা তখন শুয়েছিল। দরজা ভেজিয়ে মায়ের মাথার পাশে বলেছিলাম, ও মা, কি হবে এবার। মা অন্যমনস্কের মতো কিছু না বুঝেই উত্তর দিয়েছিল, কি আবার হবে। যা হচ্ছে তাই হবে। বুঝেছিলাম, এভাবে হবে না। মাকে দেখাতে হবে। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে জামা খুলে বলেছিলাম, আমার দিকে দেখো একবার। মা মুখ তুলে আমাকে দেখে কি বুঝেছিল কে জানে। খানিকক্ষণ কোন কথা বলে নি। একেবারে চুপ করে গিয়েছিল। অনেকপরে প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, জামাটা পরে নিয়ে নিজের ঘরে যাও। তারপর সেইদিনই সন্ধ্যে হব হব এমন সময় মা আমাকে নিয়ে পাড়ার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু আমাকে কিচ্ছু বলে নিয়ে যায় নি। শুধু বলেছিল, চল্, আমার সঙ্গে। গিয়ে বুঝেছিলাম ডাক্তারখানায় এসেছি।
যাইহোক গিয়ে বসেই ছিলাম। অনেকক্ষণ। একটার পর একটা রোগী আসছিল, ভিতরে ঢুকে ডাক্তার দেখিয়ে চলেও যাচ্ছিল। কিন্তু মা আমাকে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। এমনকি আমাদের পরেও ক’জন এসে আগে চলে গিয়েছিল। তবু মা উঠে ভিতরে যাচ্ছিল না। কারণটা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ওদিকে মা এমন গম্ভীর মুখ করে বসেছিল জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছিলাম না। এভাবে কতোক্ষণ কেটেছিল মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে প্রায় ফাঁকা হয়ে যাবার পর, মা ধীরে ধীরে যেন চোরের মতো ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। খানিকক্ষণ কথা বলে বাইরে এসে সেই দুপুরের মতো ফিসফিস করে বলেছিল, যা ভিতরে যা। তবে কোন কথা বলবি না। ডাক্তারবাবু যা বলবে তাই করবি।
আমি তো শুনে ভয়ে কাঁটা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তো কোন অসুখ করে নি। তাও ডাক্তারখানায় কেন? তার উপর মা কেন বলল, কোন কথা বলবি না। ডাক্তার যা বলবে তাই করবি…। ডাক্তার কি করতে বলবেন… ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকেছিলাম। চেনা ডাক্তার। আগেও ওনার কাছে গিয়েছিলাম। তবু সেদিন যেন ডাক্তারবাবুকে অচেনায় ঠেকেছিল। যেন প্রথম গিয়েছিলাম ওনার কাছে। প্রথমে চশমার ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখেছিলেন। তারপর ইশারায় ওনার পাশে রাখা কাঠের টুলটায় বসতে বলেছিলেন। আমি যন্ত্রবৎ ধীরে ধীরে গিয়ে বসেছিলাম। খুব বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। ডাক্তারবাবু মনে হয় অন্তর্যামী ছিলেন। অমন রাশভারী ডাক্তার কী নরম করে সেদিন বলেছিলেন, কোন ভয় নেই। আরাম করে বোসো। বলেই গলায় ঝোলানো স্টেথোটা দিয়ে আমার বুকের ঢিপঢিপানি শুনতে লাগলেন। আমি ভয়ে হোক, অস্বস্তিতে হোক চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম। হঠাৎ ডাক্তারবাবু স্টেথো রেখে আমার জামার সব কটা বোতাম খুলে বুকে হাত দিয়েছিলেন। আমি থরথর করে কেঁপে উঠেছিলাম। কিন্তু চোখ খোলার সাহস পাচ্ছিলাম না। মুখেও কিছু বলতে পারছিলাম না। ডাক্তারবাবুর সেসবে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উনি আমার বুক দু’টো হাতের মুঠোয় ভরে টিপে যাচ্ছিলেন।
সেদিন মাত্র কিছুক্ষণই ডাক্তারবাবুর হাত ওভাবে আমার বুকে খেলা করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল। আমি হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তার হোক আর যেই হোক কোন পুরুষের হাত বুকে পরলে যে সুখ হয় তা ওই প্রথম বুঝেছিলাম। শুধু যেটুকু বোঝার বাকী ছিল সেটা বুঝেছিলাম বাড়ি ফিরে। ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে আমি বেরিয়ে আসার পর মা আবার ঢুকেছিল। কারণ জানিয়েছিল বাড়ি এসে। আমার হাতে দু’রকম ওষুধ তুলে দিয়ে বলেছিল, রোজ সকালে আর রাতে খাবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
৮
মেয়ের মতো ছেলের ক্ষরণ
শোনার পরেও হয় নি মরণ
বড় হলে মাকে মেয়ের বন্ধু হতে হয়। কিন্তু ছেলের? হওয়া যায় না। ছেলে যত বড় হয়, ততই মায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাড়াতে হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আমি বোধহয় সেই হতভাগ্য মা যাকে ছেলের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করতে হয়েছিল। তবে তা যে কী ভীষণ রকম কঠিন কাজ ছিল, মুখে বলে বোঝাতে পারব না। লজ্জা আর ঘৃণা প্রতিমুহুর্তে সাঁড়াশি হয়ে আমার গলা টিপে ধরতো। মনে হত, এর চেয়ে মরণ ভালো। তবু জীবন্মৃত হয়ে ছেলের বেড়ে ওঠার গোপন কথা শুনতে হত, দেখতেও হয়েছিল।
ও তখন বছর পনেরো। একদিন দুপুরে আমার কাছে এসে, পাশে বসে নিজের জামা খুলে…। মা হয়ে মেয়ের ‘মেয়ে হয়ে ওঠা’ চোখে দেখা যায়। আমার মা যেমন আমাকে দেখেছিল। দেখেই কোলে টেনে নিয়েছিল। আদর করতে করতে বলেছিল, আহা রে। আমার মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। এবার তো মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। মোটেও না। আমি বিয়েই করব না। মায়ের কথা শুনে এরকম কিছু একটা বলে মায়ের বুকে মুখ গুঁজেছিলাম। মা-ও ‘পাগলি কোথাকার’ বলে জড়িয়ে ধরিয়েছিল। কিন্তু আমি আমার ছেলেকে তেমনভাবে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। কোন মা-ই পারবে না। মেয়েদের মতো ছেলের বুক ওঠা দেখে, তার উপর ছেলে যদি লজ্জার মাথা খেয়ে জামা খুলে সেই বুক হাট করে খুলে দেখায়, কোন মা পারবে তাকে কাছে টেনে নিতে? পারবে না। বরং অমন দৃশ্য দেখার পর পাথর হয়ে যাবে। আমিও হয়েছিলাম। পাষানী মা।
ওই মুহুর্তে ছেলেকে কি বলা উচিৎ ছিল, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একবার মনে হয়েছিল, ও যে বারবার নিজেকে মেয়ে বলত, মেয়ে ভাবতো তবে কি তা সত্যি! পরক্ষণেই মনে হয়েছিল তা কি করে সম্ভব! এখন না হয় ও বড়ে হয়ে গিয়েছে। ক’বছর আগেও ওকে চান করিয়ে দিয়েছি, জামা প্যান্ট পরিয়ে দিয়েছি, ওর শরীরের প্রতিটই কণায় তেল মাখিয়েছি। না, না, আমার ভুল হতে পারে না। ও মেয়ে নয়, ছেলে। আমার ছোট ছেলে। কিন্তু একটু আগে ও যা দেখিয়ে গেল আর নিজের চোখে তা দেখেওছি তাও তো ভুল নয়। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। ওকে তাই ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম আমি এক পাষানী মা। পাষানের বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না। ছেলে আমার চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখেওছিল। তখন ওর দু’চোখ জলে ভরে টলটল করছিল। আমি মা হয়ে ছেলের সেই জল ভরা চোখ মুছে দিতে ছুটে না গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বালিশে মুখ গুঁজেছিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল নিজেকে সামলাতে। সামলে নেওয়ার পর, মনে হয়েছিল ওর বাবাকে সব জানাই। মায়েরা যদি মেয়ের বন্ধু হয়, তাহলে বাবা হয়ে নিশ্চয় ছেলের বন্ধু হবে। কিন্তু ফোনে একটুকু শুনেই ওর বাবা খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, বাড়িতে তো ছুরি আছে। যাও ছুরি দিয়ে ওই দু’টো কেটে দাও। সব ল্যাটা চুকে যাবে। বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। কিন্তু আমার কেমন করে কাটব! নাড়ি কেটে দিলেও তার দাগ যে আজও রয়ে গিয়েছে। ওর শরীরের সেই জন্মদাগ প্রতিমুহুর্তে জানান দেয়, যে ও আমার ছেলে।
সেদিনই রাতের অন্ধকারে পাড়ার ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কোনোরকমে বলেছিলাম ওর সমস্যার কথা। ডাক্তার ওষুধও দিয়েছিল। কোন ফল হয় নি। উল্টে ক’মাস যেতে না যেতেই যা হয়েছিল তা শোনার পর কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। বিষ খেয়ে মরতে ইচ্ছে করেছিল। ঠাকুরঘরে ছুটে গিয়ে মাথা কুটে বলেছিলাম, হে ভগবান আগের জন্মে কী এমন পাপ করেছিলাম যে এজন্মে এমন শাস্তি দিচ্ছ।
ছেলেটাও তেমন বেহায়া হয়ে গিয়েছিল। নির্লজ্জ কোথাকার। নইলে ছেলে হয়ে কোনো মাকে ওসব কথা কেউ বলতে পারে! ছেলে এসে বলে কিনা ওর ওখান দিয়ে রক্ত ঝরার মতো করে সারাদিন রাত ফোঁটা ফোঁটা কিসব বের হচ্ছে। আগের মাসেও নাকি তিন চার দিন ধরে এমন হয়েছে। উঃ! কী ঘেন্না! কী ঘেন্না! সারা শরীর রি রি করে উঠেছিল। কিন্তু সেই ঘেন্না নিয়েও আমাকে আবার ছুটতে হয়েছিল ডাক্তারের কাছে। গর্ভে ধারণ করেছিলাম যে। তাই ওর বাবা অমন ছেলেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাইলেও আমি শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলাম। ছেলেটা যেন স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, মা হয়ে শুধু সেটুকু দেখার জন্যই ওসব করেছিলাম। তবে কোন লাভ হয় নি। আমার ছেলেটা জন্মেইছিল মেয়ে সেজে ঘুরে বেড়াবার জন্য।
৯
উপুর হয়ে বালিশে বুক
পিসতুতো দাদা দিল সুখ
কী নরম কাঁধ, হাত, কোমর। বুক জুড়ে নরম মাংস। মেয়েদের মতো সবই তো আছে আমার। তবু কেন আমি মেয়ে নই? এসব ভাবতাম আর নিজেই নিজের শরীরে হাত বুলোতাম। বুলোতে বুলোতে মনে হত, না না তফাৎ তো একটু আছে। আর সেই তফাৎ আমার গোপনাঙ্গ। ওই তফাৎটুকুর জন্যই আমি মেয়ে নই। তখন মনে হত, ওইটুকুই সব? বাকী শরীরটা কিচ্ছু নয়! আমার সমস্ত শরীর আর মন তো প্রতিমুহুর্তে বলত আমি মেয়ে। আর তাই একজন মেয়ে যেমন করে নবযৌবনে তার শরীরটাকে সাজায় আমিও তাই করতে লাগলাম। মাথায় চুল রাখতে শুরু করলাম। দুই হাতের নখে নেলপালিশ, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে আইলাইনার, কানে দুল, নাকে নাকছাবি। পোশাকেও নারীসুলভ ভাব। মানে এমন কিছু পড়তাম যা সরাসরি মেয়েদের পোশাক না হলেও দেখলে মেয়ে মেয়ে মনে হবে।
বাড়িতে সেই নিয়ে অশান্তি হবে জানতাম। তবে আমিও ঠিক করেছিলাম। অনেক সহ্য করেছি, আর না। মারুক, কাটুক আমি মেয়েই হব। হব বলছি কেন আমি তো মেয়েই। শরীরে একটু ভুল থাকতে পারে। কিন্তু মনের দিক থেকে আগাগোড়া আমি মেয়ে। তাইতো ছেলেদের দেখলে আকৃষ্ট হতাম। স্কুল যেতে আসতে রাস্তাঘাটে, বা বাসে অটোয় ছেলেদের ছোঁয়া লাগলে কেঁপে উঠতাম। তাই মেয়েরা যেমন করে ছেলেদের ছোঁয়াচ এড়াতো আমিও তাই করতাম। তাই দেখে প্রায় সবাই হাসাহাসি করত। তবে আমার ওসব সয়ে গিয়েছিল। আর কোন ভ্রুক্ষেপ করতাম না। এটুকু বুঝেছিলাম, বাঁচা শিখতে হলে আমাকে এমনই হতে হবে।
হয়েও উঠছিলাম। সেই হয়ে ওঠাটা দেখানোর জন্য বাড়িতে মেয়েদের পোশাক পরা শুরু করে দিয়েছিলাম। দিনের বেলাতেও নাইটি পরে থাকতাম। তাই দেখে দাদা কথা বলা বন্ধ করে দিল। মাও এড়িয়ে এড়িয়ে চলতো। আর আমি তখন আমাকে নিয়ে এমনই ব্যস্ত থাকতাম, ওসব দেখে একটুও কষ্ট পেতাম না। বরং ভালো লাগতো একা একা থাকতে পারতাম বলে।
এমন করেই বেশ কাটছিল। তাল কাটলো এক নিঝঝুম দুপুরে। ততদিনে আমার হাঁটা-চলা- শোওয়া-বসা সবই মেয়েদের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই অভ্যেসেই উপুড় হয়ে বুকে বালিশ দিয়ে বই পড়ছিলাম। আর পা দু’টো ভাঁজ করে উপুরে তুলে দোলাচ্ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে নাইটি তলার দিকটা উল্টে গিয়ে আমার পা থেকে ঊরুদেশ পর্যন্ত নগ্ন হয়ে গিয়েছিল। আর ঠিক তখনই পিসতুতো দাদা এসেছিল আমাদের বাড়ি। মা মনে হয় কোথাও গিয়েছিল। দরজা খোলা পেয়ে সরাসরি দাদার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভিতর। দাদা বাড়ি ছিল না। তাই কোন সাড়া না পেয়ে এঘর ওঘর উঁকি দিতে দিতে তার চোখ পড়েছিল আমার উপর। আমিও তার ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কে এসেছে। সেই দেখাদেখি ওকে এমনই আকৃষ্ট করেছিল যে ও ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিল। আমিও বুঝতে পারিনি আমার ভিতর কতটা শরীরের খিদে লুকিয়েছিল। ওকে দেখেই সেই খিদে চাগাড় দিয়েছিল। ও-ও আমাকে চটকে-আঁচড়ে-কামড়ে খেয়েছিল সেদিন। সেই প্রথম কোন পুরুষ আমার শরীরটা দেখে হা হা হি হি না করে আঁকড়ে ধরেছিল। আকৃষ্ট হয়েছিল আমার শরীরের প্রতি। তাই আমিও প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, ভবিষ্যতের জন্য কোন প্রতিশ্রুতি নয়, শুধুমাত্র সেই মুহুর্তের ভালোলাগাটুকু উপভোগ করতে সব উজার করে দিয়েছিলাম। পেয়েওছিলাম শরীরী সুখ।
সেই সুখ আমাকে যেন নদীর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমার তখন একটাই লক্ষ্য সাগর সঙ্গম। তার জন্য কুল ভাঙতে হলে ভাঙব। ভেঙেওছিলাম।
কদিন পর থেকে কলেজে যাওয়া শুরু করেছিলাম শালোয়ার কামিজ পরে।
চলবে……